পৃথিবীর আকর্ষণীয় এবং প্রয়োজনীয় এক পণ্যের নাম জুতা। এরও রয়েছে নানা রকম প্রকারভেদ। জুতা যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি আবার দেয় বেদনা। এটি কোনো কোনো সময় পুরস্কার আবার কোনো সময় তিরস্কার।
আমাদের পছন্দের শপিংমলগুলোতে জুতার দোকান গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে, তার সাথে প্রতিটি জামার সঙ্গে মিলিয়ে পরতে আমরা কতই না পরিকল্পনা করে জুতা কিনি। যারা খেলাধুলা এবং ভ্রমণের সঙ্গে জড়িত, তাদের জন্য তো জুতার বিকল্প নেই। ফুটবলের ইতিহাসে জুতার মূল্য সবচেয়ে বেশি। বিশ্বসেরা ফুটবলারদের পুরস্কার দেওয়া হয় জুতার উপরে একটি ফুটবল। এছাড়াও গ্রামের বয়স্করা বলেন, জুতা মানুষের পর্যায় নির্ধারণ করে। তবে কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই জুতার আবিষ্কার কীভাবে হলো?
প্রথমে শুরু করছি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস নিয়ে। এ উপমহাদেশে ১৭০০ শতকে ‘কাঠের খড়ম’ নামে এক রকমের জুতা খুব বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে জুতা তৈরি করা হতো কাঠ দিয়ে। এর মাধ্যমে যে জুতার আবিষ্কার, তা কিন্তু নয়। জুতা আবিষ্কার হয়েছে আজ থেকে আরও ৪০ হাজার বছর আগে।
জুতা আবিষ্কার আমাদের বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনায় স্থান পেয়েছিল। তিনি লিখেছেন, পথে হাঁটতে গিয়ে রাজা হবুচন্দ্র ধুলার অত্যাচারে ভীষণ অস্থির। একদিন মন্ত্রী গবুকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা এমন একটি উপায় বের করো, যাতে হাঁটতে গিয়ে পায়ে আর ধুলা না লাগে।’ এ কথা শুনে মন্ত্রী ও পণ্ডিতরা অস্থির।
অবশেষে মন্ত্রী এক চামারকে ধরে আনলেন। সে চামার চামড়া দিয়ে রাজার জন্য একটি পাদুকা তৈরি করে দিলেন। অবশেষে মন্ত্রী আর পণ্ডিতদের রক্ষা হলো। এই ঘটনার পুরোটাই ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনা। তবে প্রাচীন সূর্য মূর্তি কিংবা কার্তিকের জুতা ব্যবহার দেখে বোঝা যায়, প্রাচীনকাল থেকে ভারতে জুতার ব্যবহার ছিল।
জুতা আবিষ্কার হয়েছিল পায়ের নিরাপত্তার জন্য। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ‘এরিক ট্রিঙ্কাউস’ তুষার যুগের মানুষের দৈহিক গড়ন ও সে যুগের নিদর্শনের ওপর গবেষণা করে বলেছেন, ‘মানুষ জুতা পড়তে শুরু করেছিল প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে।’ এই কারণ ছাড়া আরো কারণ থাকতে পারে। মূলত পায়ের নিরাপত্তার কারণে জুতার ব্যবহার শুরু হয়। গবেষকরা এত বছর আগে কেনো জুতা পড়েছিল, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেননি।
জুতা ধীরে ধীরে উন্নতির ছোঁয়ায় নন্দিত। আর্মেনিয়ান এরেনিয়া-১ নামক গুহায় এক জোড়া জুতা পাওয়ার পর গবেষণা করে জানা গেছে এই জুতা খ্রিস্টপূর্ব ১৬-১২ শতকে তৈরি করা হয়েছিল এবং বলা হয়, জুতা আবিষ্কারের প্রথম দিকে দুই পায়ের জুতা এবং ছেলে-মেয়ের জুতা এক ছিল। এই জুতা পৃথিবীতে অক্ষত একমাত্র চামড়ার জুতা, যা প্রায় ৫,৫০০ বছরের পুরনো।
গবেষকেরা ধারণা করেন যে, পৃথিবীর প্রথম জুতা আবিষ্কার করা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে। কোনো কোনো গবেষক বলছেন, ইরানের সীমান্তবর্তী পাহাড়ে বসবাসকারী বাসিন্দাদের পায়ের নিরাপত্তার কারণে প্রথম জুতা তৈরি করা হয়।
জুতা আবিষ্কারের কোনো সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে না পারলেও এর আধুনিকায়ন যে ৪০০ বছর আগে হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জুতার আধুনিকায়ন শুরুর পরে কাঁদা, বরফ ও ছেলে-মেয়েদের জন্য আলাদা জুতা তৈরি হয়।
জুতা আধুনিকায়নের প্রথম দিকে কাঠের তৈরি জুতা তৈরি করা হতো এবং স্থান ভেদে এর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়।
১৮০০ শতকের দিকে কাঁদা থেকে বাঁচার জন্য ‘ওকাবো’ নামের এক ধরনের জুতা বানানো হয়। এর পরিমাপ ছিল ১৪ সেন্টিমিটার ও জুতাটি ছিল কাঠের তৈরি। এই জুতা বের হওয়ার পর বেশি ব্যবহার করেছিল নারীরা। এছাড়াও জানা যায়, এই জুতার ফিতা ছিল লাল। তবে, পাদুকা আধুনিকায়নে প্রথম হাত দেয় ইউরোপীয়রা।
ফরাসি বিপ্লবে যে পঞ্চদশ লুইকে আমরা চিনি, তারও একটি জুতার ইতিহাস রয়েছে। ১৭০০ শতকের দিকে ইউরোপীয়রা নারী-পুরুষের কথা মাথায় রেখে এক জোড়া জুতা তৈরি করেন। এর নাম রাখা হয়েছিল ‘হাই হিল’। এই হাই হিল নামের প্রথম জুতাটি ব্যবহার করেন ফ্রান্সের সম্রাট পঞ্চদশ লুই।
ছেলে এবং মেয়ে উভয় ব্যবহারের জন্য পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইতালিতে এক ধরনের কাঠের জুতা তৈরি করা হয়। এর নাম রাখা হয়েছিল ‘চোপিনস’। এই জুতার ২টি বিশেষত্ব ছিল। প্রথমত এই জুতা ছিল ক্ষুদ্রাকৃতির এবং মেয়েদের ব্যবহারের জন্য, যা তৈরি করা হয়েছিল তা ছিল ৫ ইঞ্চি পরিমাপের।
বর্ষায় কাদা পানি থেকে বাঁচার জন্য আমরা নানা ধরনের জুতা ব্যবহার করে থাকি। কাদা থেকে বাঁচার জন্য লেবানিজরা খ্রিস্টীয় ১৪-১৭ শতাব্দী এক ধরনের উঁচু কাঠ দিয়ে তৈরি জুতা ব্যবহার করতো। এর ধারণা নেওয়া হয়েছিল মধ্য যুগের জুতা থেকে।
আমরা যারা ভ্রমণ করতে পছন্দ করি, বিশেষ করে বরফের পাহাড় কিংবা বরফ আচ্ছাদিত এলাকায় ঘুড়তে যেতে পছন্দ করি এবং যারা বসবাস করেন, তারা জেনে অবাক হবেন, বরফে হাঁটার প্রথম জুতা তৈরি করা হয়েছিল গাছের ছাল দিয়ে। বিংশ শতাব্দীতে ফিনল্যান্ডে প্রথম তৈরি করা হয়েছিল সেইরকম জুতা। যা ছিল গাছের ছাল দিয়ে তৈরি। পরবর্তী সময়ে নরওয়ে, সুইডেন এবং রাশিয়া এই জুতার আধুনিকায়ন করে।
বিয়ে বাড়িতে বরের জুতা মানে অনেক কিছু। নতুন জামাইয়ের সঙ্গে ছোটরা দুষ্টুমি করতে লুকিয়ে রাখে। এই বিয়ের জুতা প্রথম তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে ফ্রান্সে। এই জুতা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এবং নবম শতকের দিকে প্রাচীন আফ্রিকার মরিশাসের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের ব্যবহৃত জুতা দেখে ধারণা করে বানানো হয়েছিল।
বর্তমানে বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ডের জুতাই আমাদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ। কোনো বিশেষ উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে জুতার বাজারে চাপ বাড়ে। ৪০ হাজার বছর আগে জুতা বানানো হলেও ডান-বাম পায়ের জন্য আলাদা জুতা তৈরি করা হয় মাত্র এক হাজার ৮৫০ বছর আগে।