ভৈরবে পাদুকা শিল্পের গৌরব

আগস্ট 27, 2023

গ্রামের বেড়ে উঠা ১৮ বছরের একজন যুবক। অভাবের সঙ্গে লড়াই করে আর পারছিলেন না। তাই অভাবজয়ের স্বপ্ন নিয়ে বন্ধুর পরামর্শে পাড়ি জমান কলকাতায়। কাজ নেন মিশুয়াবাজার স্ট্রিটের একটি পাদুকার কারখানায়।

কাজ নেন মিশুয়াবাজার স্ট্রিটের একটি পাদুকার কারখানায়। ধীরে ধীরে দক্ষ পাদুকার কারিগর হিসেবে খ্যাতি আসে তাঁর। সেই খ্যাতিকে পুঁজি করে বদলে ফেলেন ভাগ্য।একজন দরিদ্র যুবকের অভাবজয়ের এই গল্পটি চল্লিশের দশকের। গল্পের নায়ক ভৈরবের কালিকাপ্রসাদ গ্রামের ইব্রাহিম মিয়া। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলাকে পাদুকাশিল্পের শহরে পরিণত করার আদিকারিগর তিনি।
বর্তমানে নবতিপর ইব্রাহিমের হাত ধরে বিকশিত হওয়া এই শিল্পকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন ভৈরবের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কারখানা। এই খাতে বিনিয়োগ প্রায় ৬০ কোটি টাকা।ইব্রাহিমের শুরু: কলকাতার পাদুকা কারখানায় নিবিষ্টমনে কাজ শুরু করেন ইব্রাহিম। প্রতি ডজন আপার (জুতার ওপরের দিকের অংশ) তৈরির জন্য আড়াই টাকার মতো মজুরি পেতেন তিনি। ওই সময়ে এই আয় বেশ ভালোই। তাই বছর খানেকের মধ্যে নিজ গ্রামের রেনু মিয়া, রুপা গাজী ও হীরা গাজীকে কলকাতায় নিয়ে এই পেশায় যুক্ত করেন। নিয়ে যান একই উপজেলার জামালপুরের বারেক মিয়াকে। তবে ইব্রাহিম ছাড়া অন্যরা এরই মধ্যে গত হয়েছেন। শুরুর দিনগুলোর কথা মনে করতে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় ইব্রাহিম বলেন, ‘প্রায় সত্তর বছর আগের কথা। গ্রামে কাজ নাই। কী করুম। কলকাতায় গেলাম। জুতার কারিগর হইয়া গেলাম। পরে মালিক।’ বলতে থাকেন ইব্রাহিম, ‘দেখলাম কম পুঁজিতে ব্যবসাটি খারাপ না। প্রথমে গ্রামের মানুষকে বুঝাইতে শুরু করলাম। পরে অন্য গ্রামের। আমার কথায় অনেকেই বিশ্বাস রাখল। দলে দলে লোক আইল। কেউ কারিগর হইল। কেউ কারখানার মালিক।’অষ্টম শ্রেণী পাস ইব্রাহিমের আক্ষেপ, এই শিল্পে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম। শিক্ষিত লোকের অভাবেই দারুণ সম্ভাবনা থাকা শিল্পটি পুরোপুরি বিকশিত হচ্ছে না।বর্তমানে তার চার ছেলে পাদুকা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

ভৈরবে পাদুকাশিল্পের বিকাশ: ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পর প্রায় দুই দশক বড় ধরনের সমস্যা ছাড়া ভালোভাবেই ব্যবসা করেন তাঁরা। বিপত্তির শুরু ১৯৯০ সালের দিকে। পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ব্যয়ও বাড়ে অস্বাভাবিকভাবে। কমে আসে লাভ। অনেকেই তখন ঢাকা ছেড়ে ভৈরবে ব্যবসা গড়ে তুলতে থাকেন। ধীরে ধীরে ভৈরবে বিকশিত হতে থাকে পাদুকাশিল্প। ঢাকা ছাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কালিকাপ্রসাদ গ্রামের একটি কারখানার মালিক হান্নান মিয়া (৬০) বলেন, ওই সময় চাঁদাবাজেরা হাতে হলুদ নিয়ে কারখানায় ঢুকত। দেখিয়ে জিজ্ঞেস করত—এটা কী? আমরা বলতাম অলদি (হলুদ)। চাঁদাবাজেরা বলত, ‘চাঁদা দেও জলদি’।সফল যাঁরা: পাদুকাশিল্পের বদৌলতে সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন, তাঁদের একজন ‘অবাগ’ শু ফ্যাক্টরির মালিক আবদুল লতিফ। বছর দশেক আগে মাত্র তিনজন কারিগর নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। আজ তাঁর কারখানায় ৩৫ জন কারিগর। নিজের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে লতিফ বলেন, ‘১০ বছর আগের লতিফ আর আজকের লতিফ একেবারেই আলাদা।’ তাঁর মতো করেই ভাগ্য বদলাতে সক্ষম হয়েছেন আরও অনেকে।ভৈরবে পাদুকাশিল্পের সাফল্য দেখে কুলিয়ারচর ও বাজিতপুর উপজেলাতেও পাদুকাশিল্প গড়ে উঠছে। দিন দিন তা বিকশিতও হচ্ছে।

ঈদের বাজারে ব্যস্ততা: এখন চলছে সেই মৌসুম। কারখানাগুলোতে দিন-রাত কাজ চলছে। এই ব্যস্ততা থাকবে ব্যবসায়ীদের ভাষায় ‘চান রাত’ পর্যন্ত। গত শনিবার ভৈরব পৌর শহরের কমলপুর হাজি মার্কেটে গিয়ে কথা হয় কয়েকজন কারখানার মালিক ও কারিগরের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, একটি জুতা তৈরি হতে আপার, সোল, ফিটিং, ফিনিশিং, স্ক্রিন প্রিন্ট—এই পাঁচ ধাপে কারিগরের হাত লাগে। পরে প্যাকেট ভর্তি করে বাজারজাত করা হয়।চায়না শু ফ্যাক্টরির মালিক লিটন মিয়া জানান, ভৈরবে এখন স্যান্ডেল, পেনসিল হিল, ফ্ল্যাট হিলসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি হচ্ছে।ভৈরবে জুতার কারখানাগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে আরও কয়েকটি ব্যবসা। ভৈরব পাদুকা কারখানার মালিক সমিতির হিসাবমতে, জুতা তৈরির উপকরণ নিয়ে উপজেলায় অন্তত ৮০০ দোকান গড়ে উঠেছে। এসব দোকানে চামড়া, রেক্সিন, ফোম, হিল, কভার, সুতা, বোতাম, আঠা ইত্যাদি বিক্রি হয়। 

বাজারজাতের সুবিধা: ভৈরবের কারখানা থেকে তৈরি হওয়া জুতা বাজারজাত করার জন্য বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ‘মিজান মার্কেট’ নামের ছয়তলা একটি পাইকারি মার্কেট। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, ঢাকার ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই জুতা কিনে নিয়ে যান। ব্যবসায়ীরা জানান, গুণগত মানের তুলনায় ভৈরবের জুতা তুলনামূলক সস্তা।কারখানার মালিক সমিতির হিসাবমতে, প্রতিদিন গড়ে এখানে আট থেকে ১০ কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। ঈদের মৌসুমে তা বেড়ে যায়।জুতা কারখানা গড়ে তুলতে বেশি পুঁজিরও প্রয়োজন হয় না। সাধারণ আকারের কক্ষ আর হাজার পঞ্চাশেক টাকা পুঁজি নিয়ে একটি কারখানার যাত্রা শুরু করা যায়। 

6 Comments

  1. করিম মিয়া

    সেপ্টেম্বর 29, 2023

    আমি ভৈরবের একজন পাইকারি ক্রেতা , সেই সুবাদে বলতে পারি পাইকারি জুতার জন্য ভৈরব বাজার খুবই ভাল।

  2. মনির হোশেন

    অক্টোবর 10, 2023

    এখানকার তৈরি জুতা দাম অনুযায়ী মজবুত ও আরামদায়ক হয়, তাই সল্প পুঁজি তে আমার ব্যবসা ভালোই চলছে।

  3. সেলিম মিয়া

    অক্টোবর 10, 2023

    আমরা প্রতি মাসেই ভৈরব থেকে জুতা নিয়ে আসি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়াতে মালামাল সরবরাহ করতে আমাদের খরচ কম হয়।

  4. কবির চৌধুরী

    অক্টোবর 10, 2023

    ভৈরবের জুতা অনেক ভালো

  5. রাব্বী

    অক্টোবর 10, 2023

    ভৈরবে অনেক কারখানা আছে।

  6. আফতাব হোসেন

    অক্টোবর 12, 2023

    ব্যবসায়ীক আইডিয়া টা সুন্দর, নতুন উউদ্দোক্তাদের জন্য অনেক কিছু জানার আছে

Leave a Comment

Your email address will not be published.