পাদুকা শিল্পের মুকুটহীন সম্রাট

সেপ্টেম্বর 15, 2023

ফ্যাশনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ জুড়ে রয়েছে পাদুকা বা জুতা। এমন নারী পাওয়া প্রায় অসম্ভব যে নিজেকে ফ্যাশন সচেতন হিসেবে দাবি করে, কিন্তু জুতার ব্যাপারে কোনোরকম বাড়তি আকর্ষণ নেই বা তেমন একটা মাথা ঘামায় না; এমনকি পুরুষের বেলায়ও এই কথা সত্য। 

আর নারীর জুতার জন্য কোনো ডিজাইনারের কথা বলতে গেলে সবার প্রথমে যে নামগুলো আসবে, তার মধ্যে মানোলো ব্লানিক অন্যতম প্রধান। নারীদের জন্য তার ডিজাইনকৃত হিলের স্বকীয়তা ও জনপ্রিয়তার কারণেই তা একনামে ‘মানোলোস’ হিসেব প্রসিদ্ধ। প্রায় অর্ধশতক সময়কাল ধরে স্প্যানিশ এই পাদুকা শিল্পী ফ্যাশন জগতে তার স্বকীয় স্থান বজায় রেখে চলেছেন।

ম্যানুয়েল "ম্যানোলো" ব্লাহনিক রদ্রিগেজ ,(জন্ম 27 নভেম্বর 1942) একজন স্প্যানিশ ফ্যাশন ডিজাইনার এবং নামবিহীন হাই-এন্ড জুতো ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা।

প্রাথমিক জীবন ও জুতা ডিজাইনে হাতেখড়ি

৭৭ বছর বয়সী ব্লানিকের জন্ম স্পেনের ক্যানারি আইল্যান্ডের ‘স্যান্তা ক্রুজ দে লা পামা’তে ১৯৪২ সালের ২৭ নভেম্বর। দুই ভাই-বোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন ব্লানিক। তাদের দুজনের জন্যই বাড়িতে পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হয়। তবে তারপরে তিনি সুইজারল্যান্ডে একটি বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী একজন কূটনৈতিক হিসেবে কাজ করার জন্য তিনি ইউনিভার্সিটি অফ জেনেভাতে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম সেমিস্টার পার করেই তিনি বিষয় বদল করে সাহিত্যে পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং ১৯৬৫ সালে ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপরেই তিনি শিল্প বিষয়ে পড়ালেখা করতে প্যারিসে চলে যান এবং সেখানে ইকোল দে লা বো-আর্টসে ভর্তি হন। একইসাথে তিনি ল্যুভর আর্ট স্কুলে সেট ডিজাইনের কাজও শিখতে থাকেন। প্যারিসে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘদিন যাবত প্রতিষ্ঠিত ও প্রসিদ্ধ একটি কাপড়ের দোকানে খন্ডকালীন কর্মী হিসেবে কাজও করতেন।

তার পরিবার শুরু থেকেই আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর্থিক মন্দার সসেব কীভাবে সহজেই প্রাপ্ত বিভিন্ন উপাদান, যেমন- কাঠ, চামড়া, ফিতা ও লেস দিয়ে নিজেই রুচিশীল জুতা বানাতে পারবে- তা একজন মুচি, ব্লানিকের মাকে শিখিয়ে দেয়। এভাবেই খুব অল্প বয়সেই জুতা ডিজাইন করার প্রতি ব্লানিকের আগ্রহ জন্মায়। প্রথমদিকে তিনি তার পোষা প্রাণীর জন্য মসলিন কাপড় ও সুতির ফিতা দিয়ে জুতা তৈরি করতেন।

পেশা হিসেবে জুতা ডিজাইন

১৯৭০ সালে আমেরিকান ভোগ এর তৎকালীন প্রধান সম্পাদক ডায়না ভ্রিল্যাণ্ড ব্লানিকের তৈরি স্কেচের ডিজাইন দেখে তাকে জুতার ডিজাইন করার জন্য উৎসাহ দেন। তবে পেশাদারিভাবে জুতার ডিজাইন শুরুর আগে, ১৯৬৮ সালে তিনি লন্ডনে এসে জাপাটা ফ্যাশন বুটিকে কাজ করতে শুরু করেন। এরপরে অল্প সময়ের জন্য তিনি দ্য সানডে টাইমসে ফটোগ্রাফার ও ইতালিয়ান ভোগ-এর লেখক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে তিনি দ্য ফেদার্স বুটিকের জন্য জিন্স ক্রয়ের কাজ করতেন। ডায়নার উৎসাহে পরের বছর থেকেই ব্লানিক জুতা ডিজাইনের কাজ পেশাদারিভাবে শুরু করেন। 

প্রথমে তিনি জাপাটার জন্য জুতা ডিজাইন করেন, এরপরে ১৯৭২ সালে ইংরেজ ডিজাইনার ‘ওসি ক্লার্ক’ এর জন্য তার প্রথম জুতার কালেকশন ডিজাইন করেন। এই কালেকশনের ‘চেরি শুজ’ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। গোড়ালির কাছে সবুজ রঙের ফিতা বাঁধা এই হিলের নকশায় ছিল ঐ ফিতা থেকে ঝুলন্ত কৃত্রিম চেরি ফল। টুইগি সহ বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ মডেল এই জুতার প্রদর্শনী করেছিলেন। ব্লানিকের তৈরি প্রথম এই কালেকশনটি খুব দ্রুত ফ্যাশন সচেতনদের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ছোটবেলার শখকে পুরাদস্তুর পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য ব্লানিক অল্প সময়ের জন্য ইস্ট লন্ডন ও নর্দামটনে জুতা তৈরির বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জাপাটার মালিকানা ক্রয় করে নিজের বুটিক প্রতিষ্ঠা করেন। বিয়াঙ্কা জ্যাগার ছিলেন তার প্রথমদিককার ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তী বছরে ব্লানিক ইতিহাস গড়েন প্রথম পুরুষ হিসেবে ভোগ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে স্থান করে নিয়ে, যদিও তার সাথে অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিকা হিউস্টনও ছিলেন। ১৯৭৭ সালে জ্যাগার ‘স্টুডিও ৫৪’ এর ডিস্কোতে সাদা ঘোড়ায় চড়ে প্রবেশের যে স্মরণীয় ঘটনার অবতারণা করেছিলেন, সে সময়ে তার পরনে ছিল এক জোড়া ‘মানোলোস’। এই ঘটনায় ব্র্যান্ডটির বেশ ভাল প্রচারণাও হয়ে যায়।

তুলনামূলক হালকা ওজনের সূক্ষ্ম নকশাদার স্টিলেটো বা উঁচু হিল, একইসাথে নারীত্ব সুলভ সংবেদনশীল আবেদন ও সম্ভ্রমকে ফুটিয়ে তুলতে মানোলোস বিশ্বের সকল ফ্যাশন সচেতন নারীর কাছে সবচেয়ে বেশ পছন্দের জুতা। তার তৈরি জুতায় পালক, চেইন, পশুর লোম, ফিতা, বিভিন্ন ধরনের পুঁতি, সিল্কের কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যার ফলে তার ডিজাইনকৃত জুতা এক নজরেই চেনা যায়। উঁচু হিলের পাশাপাশি ফ্ল্যাট জুতা ও ক্লাচ বা ছোট আকারের ব্যাগও তিনি ডিজাইন করেন।

আধুনিক যুগে, বিশেষত জুতার ডিজাইনারেরা যেখানে গণহারে একেকটি ডিজাইনের জুতা তৈরি করেন, সেখানে ব্লানিক আজও নিজ হাতে তার নিজের করা প্রতিটি ডিজাইনের জুতা তৈরি করেন। জন গ্যালিয়ানো, কেলভিন ক্লেইন ও ইভস্ সাঁ লরঁ এর মতো প্রসিদ্ধ ডিজাইনারের ডিজাইনকৃত পোশাকের সাথে মিল রেখে নির্দিষ্ট কালেকশনের জন্যও তিনি বিশেষভাবে জুতা তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি উক্ত ডিজাইনারদের সাথে যৌথভাবে চুক্তিবদ্ধ থাকেন, শুধু জুতার ডিজাইনের জন্য।

পুরস্কার, বিশেষ প্রচারণা ও অন্যান্য অর্জন

পরের বছরে ব্লানিক বিলাসী পণ্যদ্রব্যের খুচরা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘ব্লুমিংডেল’-এর জন্য একটি জুতার কালেকশন ডিজাইন করেন। এরপরই তিনি বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ১৯৮৮ সালে পাওয়া ‘ফ্যাশন কাউন্সিল অফ আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড’, ১৯৯০ সালে পাওয়া- কাউন্সিল অফ ফ্যাশন ডিজাইনার্স অফ আমেরিকা (সিএফডিএ)- এর ‘অ্যাক্সেসরি ডিজাইনার অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কার, একই বছরে পাওয়া ‘দ্য ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিল অ্যাক্সেসরি ডিজাইনার’ পুরস্কার এবং ১৯৯৭ সালে পাওয়া, সিএফডিএ- এর ‘স্টিলেটো’ পুরস্কার।

ফ্যাশন শো ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে মডেল ও অতিথিদের পরনে থাকার কারণে প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ হওয়া ছাড়াও, টেলিভিশনেও ব্লানিকের তৈরি জুতা স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ১৯৯২, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ২০০১ ও ২০০৩ সালে মোট পাঁচটি পর্যায়ে প্রচারিত ব্রিটিশ টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘অ্যাবসোলিউটলি ফ্যাবুলাস’ এ ব্লানিকের ডিজাইনকৃত জুতা পরিবেশিত হয় এবং প্রসিদ্ধি লাভ করে। এছাড়াও ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ছয়টি পর্যায়ে প্রচারিত আমেরিকার টেলিভিশনের অন্যতম জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘সেক্স এন্ড দ্য সিটি’তে একাধিকবার মানোলো ব্লানিক ব্র্যান্ডটিকে কেন্দ্র করে উল্লেখযোগ্য ঘটনা দেখানো হয়। অনুষ্ঠানটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘ক্যারি ব্যাড’ এর জুতার প্রতি আসক্তি, বিশেষ করে মানোলোস নিয়ে তার আবেগ ব্র্যান্ডটিকে অন্যরকম উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

২০০৩ সালে লন্ডনের ‘ডিজাইন মিউজিয়াম’ এ প্রথমবারের কোনো জুতা ডিজাইনারের কাজের প্রদর্শনী করা হয়, আর সেই ডিজাইনার ছিলেন মানোলো ব্লানিক। এই প্রদর্শনীতে তার কাজ তথা ডিজাইনকৃত জুতার পাশাপাশি ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘মানোলো ব্লানিক: ডিজাইনস’ বইটিরও মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ব্লানিকের কাজ নিয়ে ২০০৫ সালে ফটোগ্রাফার এরিক বোম্যান একটি ফটোবুক প্রকাশ করেন- ‘ব্লানিক বাই বোম্যান: অ্যা ফটোগ্রাফিক কনর্ভাসেশন’। ২০০৬ সালে ম্যারি অ্যান্টোয়নেট এর জীবনী নির্ভর চলচ্চিত্রের জন্যও ব্লানিক জুতার ডিজাইন করেন। ২০০৭ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, ব্রিটিশ ফ্যাশন শিল্পে অবদানের জন্য ব্লানিককে ‘কমান্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ সম্মানে ভূষিত করেন। ২০১০ সালে ‘মানোলোস নিউ শুজ: ড্রয়িংস বাই মানোলো ব্লানিক’ নামের বইটি প্রকাশিত হয়।

3 Comments

  1. জাকির

    অক্টোবর 24, 2023

    তথ্য বহুল আলোচনা

  2. ফরজ আলী

    অক্টোবর 24, 2023

    জুতার ইতিহাস এই প্রথম জানলাম

  3. রনি তালুকদার

    অক্টোবর 25, 2023

    এই প্রথম জুতা শিল্পের সম্রাট কে দেখলাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published.